Header Ads

▶️ রোহিঙ্গা এক লারকি। পর্ব-৪

 


আগের পর্ব ▶️ রোহিঙ্গা এক লারকি। পর্ব-৩

পিপলস্ রিপাবলিক অব রাখাইন

রাখাইন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরি করতে একটি সেলিব্রেশন সেশনের আয়োজন করেছে জাতিসংঘ। এপ্রিলের ১৪ তারিখে নিউইয়র্কে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টকে ওই অনুষ্ঠানে রাখাইনের সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত প্রস্তুত করে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট রাখাইনকে পিপলস্ রিপাবলিক বা গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছে। তৈরি হয়েছে রাখাইন রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র। সেখানে বলা হয়েছে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার; এই চারটি মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে নতুন জন্ম নেয়া এই জনপদটি।

সবচেয়ে বড় আগ্রহের বিষয় হলো, ১৪ এপ্রিলের ওই সেলিব্রেশন সেশনে প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে আসবেন ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের প্রধান নেতা ফাতেমা মংডু। যার নেতৃত্বে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে এক প্লাটফর্মে সমবেত হয়েছে মিয়ানমারের মানুষ এবং তার হাত ধরেই অবশেষে স্বাধীন হয়েছে রাখাইন। সেই বহুল আলোচিত নেতা ফাতেমা মংডুকে এখন পর্যন্ত কেউ স্বচক্ষে বা গণমাধ্যমের বদৌলতে দেখতে পায়নি। সবসময়ই তার মুখপাত্র হিসেবে আবিদা জেরিনই কথা বলেছেন। কিন্তু ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১৫ বছর পর তিনি প্রকাশ্য জনসম্মুখে এবং মিডিয়ার সামনে আসবেন, এটাই অনেকের কাছে আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

অবশ্য এ বিষয়ে ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সংগঠনেরই কিছু নিজস্ব কর্মপন্থা ও কৌশল রয়েছে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা ফাতেমা মংডু কোন ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নেননি এবং মিডিয়ার সামনে আসেননি।

একজন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী হয়ে কিভাবে মিয়ানমারের মূল স্রোতে প্রথমে একটি মানবাধিকার সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন, পরে সেই সংগঠনকে রাজনৈতিক প্লাটফর্মে নিয়ে গেলেন এবং সেই সংগঠনে শুধু মুসলিম রোহিঙ্গা নয়, যুক্ত করলেন মিয়ানমারের সর্বস্তরের মানুষকে; এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি কেউই। সুতরাং নানা কারণেই জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন ফাতেমা মংডু। অতএব ফাতেমাকে ঘিরে সারা পৃথিবীর উচ্ছ্বাস থাকাটা একেবারেই যৌক্তিক।

মাশরুর আবরারের শোক এখনো কাটেনি। মস্তিষ্কে শুধু আবিদা জেরিনের চিন্তা। হৃদয় ভেঙে যাওয়া দুঃসহ কষ্ট কোনোভাবেই বুকের ওপর থেকে সরাতে পারছেনা সে।

সুখের খবর হলো, বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আবরার জাতিসংঘের ১৪ এপ্রিলের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন।

নিউইয়র্কের যাবার প্রস্তুতি নিয়েও খানিকটা ব্যস্ত সময় পার করছে সে। আবিদা জেরিনের সঙ্গে নিজের সখ্যতা, ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের প্রতি বাংলাদেশের সহায়তার বিষয়গুলো সুযোগ পেলে এবার ফাতেমা মংডুর সামনে উত্থাপন করার কথা খুব জোরালো ভাবেই ভাবছে আবরার।

সেলিব্রেশন অব রাখাইন স্টেট জাতিসংঘের সদর দপ্তর। বহু কাঙ্ক্ষিত সেই অনুষ্ঠান। নাম দেয়া হয়েছে- সেলিব্রেশন অব রাখাইন। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি মটলি ওলনদাশ, সেশনের উদ্বোধন করেন। এরপর রাখাইন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

এরপর ঘোষণা আসে ফাতেমা মংডুর নাম। তিনি রাখাইন রাষ্ট্রের রূপরেখা উপস্থাপন করবেন।

জনাকীর্ণ কনফারেন্স কক্ষ। অনুষ্ঠানে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিতি রয়েছেন। রয়েছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সংস্থার প্রতিনিধি। বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। আবরার অনেক কষ্টে হলরুমের শেষ প্রান্তে একটি আসন পেয়েছেন।

মঞ্চে উঠেছেন ফাতেমা মংডু। সহস্র ক্যামেরার আলো ঝলকানি। কেউই এই দুর্লভ মুহূর্তের ছবি মিস করতে চাইছে না।

লং গাউনে জড়ানো একহারা শরীর। মাথায় উজবেকিস্তানি ক্যাপ। সাদা গাউন এবং নীলে ক্যাপে অসাধারণ লাগছে ফাতেমা মংডুকে। মাশরুর আবরারের চোখে অপার বিস্ময়। চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

: আরে এ আমি কি দেখছি! এ তো আবিদা জেরিন। হ্যাঁ, সত্যিই তো। সেই ইস্তাম্বুলে সাক্ষাৎ হওয়া আবিদা জেরিন! আবরারকে পাঠানো ইলেকট্রনিক চিঠির প্রেরক আবিদা জেরিন!

আবিদা কিভাবে ফাতেমা মংডু হয়! তাহলে কি একই চেহারার ভিন্ন দু'জন নারী। না, এটা কিভাবে সম্ভব! চেহারার মিল নাও থাকতে পারে কিন্তু কণ্ঠও এক হয় কিভাবে?

আবরার একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন।

এদিকে মঞ্চে উঠেই খুব সংক্ষিপ্ত করে রাখাইনের রূপরেখা উত্থাপন করলেন ফাতেমা মংডু। তুলে ধরলেন রাখাইনের নিজস্ব পতাকা। পাশাপাশি গাইলেন নতুন রাষ্ট্রটির জাতীয় সঙ্গীত। জানা গেলো, মহাকবি আলাওলের একটি কবিতাকে করা হয়েছে রাখাইনের জাতীয় সঙ্গীত।

পিনপতন নীরবতা। সবাই সুতীব্র মনোযোগ দিয়ে শুনছেন ফাতেমার উপস্থাপনা। শুধু ক্যামেরার ফ্ল্যাশিংয়ের শব্দ ছাড়া আর কোন নয়েস নেই পুরো হলরুমে।

ফাতেমা মংডুর প্রেজেন্টেশন শেষে অনুষ্ঠানে আগত রাষ্ট্রপ্রধানরা উঠলেন মঞ্চে। রাখাইনের পতাকা সামনে রেখে তারা ফাতেমার সঙ্গে ফটোসেশন করলেন।

আবরারের এইসবে মন নেই। সে শুধু চিন্তা করছে যে করেই হোক, ফাতেমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতেই হবে। আবরার মোটামুটি নিশ্চিত যে, ফাতেমা মংডুই তার আবিদা জেরিন।

আহা ফাতেমা আহা আবিদা

১০ ঘণ্টার প্রাণান্ত চেষ্টা। অবশেষে ফাতেমা মংডুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎ। জাতিসংঘের সদর দফতরের ভিভিআইপি রেসিডেন্সে। মাশরুর আবরার তার বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরেন। ফাতেমা মংডুর মুখপাত্র আবিদা জেরিনের সাথে তার যে দীর্ঘ যোগাযোগ ছিলো সে বিষয়টিও জানায় সে। কিন্তু পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ফাতেমা মংডুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জানান যে, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে তাদের নেত্রী হাই সিকিউরিটির মধ্যে রয়েছেন। সুতরাং এই মুহূর্তে সাক্ষাৎ অসম্ভব।

কিন্তু মাশরুর আবরার নাছোড়বান্দা। ফাতেমা মংডুর কাছে একবার তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যগুলো জানাতে শেষবারের মতো অনুরোধ করে আবরার। রাজি হয় সেক্রেটারি। আরো দুই ঘণ্টা অপেক্ষা। অবশেষে আসে সেই বিরল মুহূর্ত।

ভিভিআইপি রেন্সিডেন্সের অতিথিশালা। আবরার আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। প্রতীক্ষার বৃষ্টি ঝরিয়ে এলেন ফাতেমা মংডু।

আসসালামু আলাইকুম। আমি আবরার, কাম ফ্রম ঢাকা।

ওয়া আলাইকুমুস্সালাম। আপনি মাশরুর আবরার। তাইতো।

হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানেন?

জানি, যেভাবে আপনি আমাকে চেনেন জানেন!

তাহলে আপনিই কি আবিদা জেরিন?

হ্যাঁ, আবিদা জেরিন। আবার আমিই ফাতেমা মংডু।

- প্লিজ আমাকে খুলে বলুন। গত ২৪ ঘণ্টা আমি ঘুমোতে পারিনি। এটা কিভাবে সম্ভব, আমার ইলেকট্রনিক চিঠি প্রেরক আবিদা জেরিন কি ১৫ মার্চের গণহত্যায় মারা যায়নি তাহলে?

সব ঠিক আছে। শুনুন তাহলে। ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে আবিদা জেরিন হলো প্রতীকী একটা নাম। ২০১৭ সালে রাখাইনে প্রথমে গ্যাংর‍্যাপ, পরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার শিকার হয় আবিদা জেরিন নামের এক কিশোরী। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে অস্ত্র ছিনতাই করে ৪০ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে। এই ঘটনা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচিত হয় এবং আবিদা জেরিন রোহিঙ্গাদের মাঝে এক অনন্য অনুপ্রেরণায় পরিণত হন। সেই থেকে রাখাইনের অনেক তরুণী নিজেদের নাম পাল্টে রাখতে শুরু করে আবিদা জেরিন। আমাদের ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে কমপক্ষে ১০০ নেত্রী রয়েছেন, যাদের নাম আবিদা জেরিন। তবে প্রত্যেকের নামের সঙ্গে আলাদা আলাদা কোড যুক্ত করা আছে। যেমন- আবিদা জেরিন ওয়াই, আবিদা জেরিন এক্স ইত্যাদি। ১৫ মার্চের গণহত্যায় আমাদের বেশ ক'জন আবিদা জেরিন মারা গেছেন। আর আমি হলাম আবিদা জেরিন পি অর্থাৎ আবিদা জেরিন প্রাইম। তবে আমার প্রকৃত নাম ফাতেমা মংডু। কৌশলগত কারণে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো ফাতেমা মংডুর মুখপাত্র হিসেবে। কিন্তু আমিই যে ফাতেমা মংডু তা এতদিন একেবারেই গোপন রাখা হয়েছিলো।

ফাতেমার কথাগুলো চরম বিস্ময়ে শুনছে মাশরুর আবরার। নিজেকে ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী মনে হচ্ছে। মনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভালো লাগার অনুভূতি; আমি যার মুখোমুখি, যাকে ভালোবাসি, তিনি একটা রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন!

হঠাৎ তীব্র শব্দ। বোমা বিস্ফোরণের মতো শব্দ। হ্যাঁ, বোমা বিস্ফোরণই। অতিথিশালার সবকিছু ছিন্নভিন্ন। মুহূর্তেই সব শেষ। ফাতেমা মংডু এবং আবরারের রক্তাক্ত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্পট ডেড হয়েছেন আরো ৩ জন গার্ড।

মুহূর্তে পুরো ভবনে জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট। ১০ মিনিটের মধ্যে প্রায় হাজার খানেক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ঘিরে ফেলে পুরো ভবন। চলতে থাকে তল্লাশি। তবে ধারণা করা হচ্ছে ৩ জন গার্ডের একজন আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে।

একদিন আগে নতুন রাষ্ট্র রাখাইনের সেলিব্রেশনে উচ্ছ্বসিত ছিলো গোটা বিশ্ব। আর একদিন না পেরোতেই এরকম মর্মান্তিক খবর। শোকে মুহ্যমান কোটি কোটি মানুষ। সন্ধ্যায় বিবিসি জানায়, আইএস এ আত্মঘাতী হামলা করেছে। ইতোমধ্যে তাদের ওয়েবসাইটে এ হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে।

বিবিসি আইএস এর যে বিবৃতি প্রকাশ করে তা হলো: "শুধু রাখাইন নয়, আমাদের পরিকল্পনা ছিলো গোটা মিয়ানমারই হবে একটি ইসলামী রাষ্ট্র। সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছিলো আইএস। কিন্তু ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট নামের সংগঠনের মাধ্যমে ফাতেমা মংডু আইএস এর সেই স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। এ কারণে এই আত্মঘাতী হামলা।"

তবে, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আইএসই হোক বা অন্য যে সংগঠনই হোক না কেন এ হামলার সঙ্গে সরাসরি মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা যুক্ত।

মৃত্যু মানে শেষ নয় আদর্শিক বিজয়ের সূচনা

 অনেকে মনে করেন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের যবনিকা ঘটে। কিন্তু না। একবার রাখাইনের দিকে তাকান। লাখ লাখ মানুষের শাহাদাতের কারণেই জন্ম হয়েছে একটি দেশের। যার ফলে হাজার স্বপ্নের কুসুম প্রস্ফুটিত হতে পেরেছে। অনেক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠী পেয়েছে নতুন জীবন। এরচেয়ে মহৎ বা বড় আর কি হতে পারে!

রাখাইন পরিদর্শনে এসে এই উপলব্ধিগুলো বারবার মনের ভেতর নাড়া দিচ্ছে অধ্যাপক ড. সাদেকের। ২ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি টেকনিক্যাল টিম এসেছে এখানে। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মাসুদ আদনান। সঙ্গে রয়েছেন অধ্যাপক ড. সাদেক, আবরারের বন্ধু ড. সুভাস এবং ড. লতিফ খান।

তারা ঘুরে ঘুরে সমগ্র রাখাইন দেখছেন। রাখাইনের প্রতিটি বাড়িতে উড়ছে নতুন পতাকা। লালের মধ্যে বৃত্তবন্দী নীল। ঠিক বাংলাদেশের পতাকার মতোই। তবে পতাকার জমিন লাল এবং ভেতরে বৃত্তের মধ্যে নীল। লাখ লাখ রোহিঙ্গার শাহাদাতকে তারা লাল রঙে চিহ্নিত করছে আর নীল রঙ দিয়ে তারা আকাশের মতো উদারতা বা মানবতাকে বুঝাচ্ছে। তবে ভালোলাগার বিষয় হচ্ছে অনেক বাড়িতে রাখাইনের পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকাও উড়ছে। সম্ভবত বাংলাদেশে এতদিন যারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ে ছিলেন তারাই এ কাজটি করেছে। হয়ত বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।

টিমের সবাই খুব গভীরভাবে অনুভব করছে মাশরুর আবরারের অনুপস্থিতি। রাখাইন নিয়ে তার যে স্বপ্ন ছিলো, সেটা তাদের বারবার মনে পড়ছে।

রাখাইনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মংডু হবে তাদের রাজধানী। সেই জন্য তারা অবকাঠামোগত কাজও শুরু করেছে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও এই বিধ্বস্ত নয়া রাষ্ট্রটির সহায়তায় ১০০০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব করেছে। রাখাইন এবং বাংলাদেশ, দু দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে পুনর্গঠনের কাজে বেশ আন্তরিক মনে হচ্ছে।

আর পুরো দেশের অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করছে তুরস্ক। দিন যত যাচ্ছে রাখাইনে শত শত গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে পাওয়া গেছে ৮০০টি গণকবর। সবমিলিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক আনুমানিক দুই লাখ মানুষকে হত্যা করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব তথ্য প্রমাণ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠানোও হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ২০৩৬ সালের শুরুর দিকে এই বিচারকাজ শুরু হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ফাতেমা মংডুর মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রকৌশলী আব্দুল ফাতেহ। এখন তার নেতৃত্বেই এগিয়ে চলছে রাখাইন। রাষ্ট্রটির সীমানা নির্ধারণের কাজটি করছে জাতিসংঘই। এই কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোাতে অসংখ্য মাইন পেয়েছে তারা। অধিকাংশ অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দুই দিন আগে মাইন বিস্ফোরণে জাতিসংঘের এক কর্মীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

সুতরাং এসব বিষয়ের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কতটা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

আশা করা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু হলে গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী কয়েক শত সামরিক কর্মকর্তার শাস্তি নিশ্চিত হবে।

একটা লোকালয় পেরিয়ে গাছগাছালিপূর্ণ জঙ্গলের মতো এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে টিম। অগ্রভাগে ড. মাসুদ আদনান। হঠাৎ সুউচ্চ একটা টাওয়ার চোখে পড়ে তাদের। পুরনো টাওয়ার। বিদ্যুতের হবে সম্ভবত। তবে এখন পরিত্যক্ত।

টাওয়ারের উপরে সুবিশাল একটা ব্যানার। ধবধবে সাদা জমিনে লাল রঙে কি যেন লেখা! পুরো টিম-ই থমকে দাঁড়ায়। বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। টিমের সদস্যরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। রোহিঙ্গাদের কৃতজ্ঞতাবোধে তারা আপ্লুত।

প্রশান্তির বাতাস যেনো ছুঁয়ে গেলো সবার শরীর। বসন্তকাল বলে রক্তবর্ণ প্রকৃতি। চারপাশে শিমুলের মতো অচেনা ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফুলগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, মনে হচ্ছে কেউ যেন লাল গালিচা বিছিয়ে আন্ত রিক অভিবাদন জানাচ্ছে। নাম না জানা পাখির কুউক কুউক ডাকও ভেসে আসছে। এ এক অসাধারণ অভিভূত করা পরিবেশ।

মিনিট দশেক ধরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে টিম। এক পা-ও এগুচ্ছে না। সবাই স্তব্ধ। কেবল আকাশে দোল খাওয়া টাওয়ারের ব্যানারটা সদর্পে শির উঁচু করে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ব্যানারের লেখাগুলোও কেমন প্রজ্বলিত হয়ে আছে।

বাংলাদেশের প্রিয় হে মাশরুর আবরার, রাখাইন তোমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ, স্যালুট হে বন্ধু।

নিজেদের অজান্তেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাসুদ আদনানসহ অন্যরাও একটা লম্বা স্যালুট তুলে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে কি যেন ভাবছে! সম্ভবত তারা ভাবছে, মৃত্যু মানে শেষ নয়, আদর্শিক বিজয়ের নতুন সূচনা।




No comments

Powered by Blogger.
Chat with us on WhatsApp